আইনিভাবে প্রমাণ করেই যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ অন্যদের পাচার করা সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। তবে এর আগে দুদককে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই দেশে পাচার অর্থে সম্পত্তি অর্জনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রমাণ করতে হবে। তার পরই সে দেশের আদালত অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেবেন।
যুক্তরাজ্য সফর শেষে সোমবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও আমি আমাদের কাজে লন্ডন গিয়েছি। সে সময় প্রধান উপদেষ্টার সফরও ছিল। তবে যাঁর যাঁর কর্মসূচি ছিল ভিন্ন। আমাদের কর্মসূচি আগে থেকেই সে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) সঙ্গে ঠিক করা ছিল। এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টিকরাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (আইএসিসিসি) সঙ্গে আমরা কাজ করছি।
বিভিন্ন দেশে যারা সম্পদ পাচার করেছেন, তাদের প্রাথমিক যে তালিকা আমাদের কাছে আছে, সেটি আদালতের আদেশসহ সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়েছি। এনসিএ ভালো কাজ করেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের বেআইনিভাবে উপার্জিত ও পাচার করা অর্থে কেনা প্রচুর সম্পত্তি এনসিএর সহায়তায় জব্দ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ২৫ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সাবেক ভূমিন্ত্রীর ৫৮০টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৪৩টি বাড়ি যুক্তরাজ্যে, ২২৮টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবং ৯টি যুক্তরাষ্ট্রে। ৩৪৩টি বাড়ির আনুমানিক মূল্য ৭৩.১৫ মিলিয়ন পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।
আরও ৩৫ কোটি টাকা জব্দ
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ব্যাংকে জাবেদের ২.৫ মিলিয়ন ডলার জমা আছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩৫ কোটি টাকা। এ অর্থও জব্দ হয়েছে। ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, বিভিন্ন জায়গায় তাঁর আরও সম্পদ রয়েছে, যেগুলো নিয়ে দুদক কাজ করছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থায় সঠিকভাবে কাগজপত্র পাঠানো হলে এ ক্ষেত্রেও সুফল আসবে। জাবেদের পাচার অর্থ উদ্ধারে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদ অনুযায়ী দুদক থেকে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েন্ট (এমএলএআর) যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য প্রথম সাড়া দিয়েছে। যুক্তরাজ্য সফরকালে আইএসিসিসি ও এনসিএর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা যায়, পাচার করা অর্থ উদ্ধার সারাবিশ্বে একটি জটিল বিষয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কম। এই কাজে দুদকের কর্মদক্ষতা বাড়াতে এনসিএ সহায়তা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ দুদকের সঙ্গে কাজ শুরু করবেন।
অর্থ ফেরত আসবে যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়ে
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। গভর্নর নিজে লন্ডন গিয়েছেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত পাচার হওয়া জব্দ সম্পদ আমরা আনতে পারব কিনা, এটির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রেখা রয়ে গেছে। সেটির জন্য আমাদের সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের আদালত থেকে যেমন আদেশ দেওয়া হবে, তেমনি যুক্তরাজ্যের আদালত যদি আদেশ দেন, তখনই সম্পদ ফেরত আনা যাবে।
লন্ডনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাজ্য এবং স্পট লাইট অব করাপশন– এই তিন সংস্থা একযোগে বিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছে পাচার অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দিতে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) একসঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যে মামলাগুলো করা হয় দুদক থেকে। তাই পাচার টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে কি হবে না– এই কাজটি দুদককেই করতে হবে।
যুক্তরাজ্যে আরও যাদের সম্পদ
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বাকিদের পাচার সম্পদ উদ্ধারেও দুদক কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ভাই রনির সম্পত্তি, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান চৌধুরীর দুই ছেলে সাফিয়াত সোবহান সানভীর ও সাফওয়ান সোবহানের সম্পত্তি ফেরত চেয়ে দুদক থেকে তথ্য পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে পাচারকারীর সঙ্গে আলোচনা করে অর্থ ফেরত আনার চেষ্টাও করা হচ্ছে। তবে দুদক যেসব মামলা করেছে, সেখানে কোনো ধরনের সমঝোতা করা সম্ভব নয়।
অর্থ ফেরত আনার সাফল্য নগণ্য
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, পাচার অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে দুদকের যে সাফল্য রয়েছে, তা খুবই সামান্য, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার। প্রথমত, দেশের টাকা আরেক দেশে চলে গেলে, সেই দেশ ফেরত দিতে না চাইলে– সে ক্ষেত্রে কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু আমরা যদি আইনিভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হই, যদিও এটা মোটেও সহজ কাজ নয়– তার পরও আমরা আশাবাদী। দেশ থেকে যত টাকা পাচার হয়েছে, তার সব টাকা আমরা ফেরত আনতে পারব– আমি সেটা বলতে চাচ্ছি না। আমরা যতটুকু প্রমাণ করতে সক্ষম হব, ততটুকু ফেরত আনার ক্ষেত্রে আশা করা যায়।
দেশের নাগরিক হিসেবেই টিউলিপের বিরুদ্ধে মামলা
ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, টিউলিপ সিদ্দিক ইতোমধ্যে দুদকের তিনটি মামলার আসামি। আরেকটি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে। তিনি ২০১৩ সালে খামারের মাছ বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা আয় করেছেন– এই খবরও এসেছে। এটা নিশ্চই তাঁর আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই তিনি যতই বলুন না কেন তিনি ব্রিটিশ নাগরিক, এ ক্ষেত্রে দুদক যখন কাগজপত্র দেখছে, তাঁকে বাংলাদেশিই মনে হচ্ছে। নিজে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিজেকে কখনও ব্রিটিশ, কখনও বাংলাদেশি বলছেন– এটি মোটেও সমীচীন নয়। টিউলিপের বিরুদ্ধে দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। টিউলিপের ঠিকানায় দুদক থেকে চিঠিপত্র পাঠানো হচ্ছে। রাজউকে প্লট ও গুলশানে ফ্ল্যাট ছাড়াও তার আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে।
উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেও আমলে নেওয়া হবে
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুদকের আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। শুধু পিএস, এপিএস নয়, উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দুদক তা আমলে নেবে।
দ্বৈত নাগরিকত্ব বন্ধ হওয়া দরকার
তিনি বলেন, বর্তমানে পাশের দেশে অনেকে অবস্থান করছেন। সেখানে তাদের থাকা-খাওয়ার খরচ লাগছে। এই খরচের টাকাটা দেশ থেকেই যাচ্ছে। সেদিকে দুদক নজর রাখছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এটি বন্ধ করা গেলে অর্থ পাচার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
সাঈদা মুনার ২ হাজার কোটি টাকা পাচার
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম ও তাঁর স্বামী ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম পরস্পর যোগসাজশে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেডসহ ১২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন।
বতর্মানে যারা বিদেশে অবস্থান করছেন, তারা তাদের দেশের সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তারা অনেককে সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিচ্ছেন। এ বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।