নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনাস্থা বৃদ্ধি হবে ট্রাম্পের অস্বীকৃতি

কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ইতিহাসে নেতাদের আবির্ভাব ঘটে দুবার—প্রথমবার ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত হিসেবে, দ্বিতীয়বার ফার্স বা প্রহসন হিসেবে। মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করে চলেছেন, তাতে অবশ্য হিসাবটা উল্টো। প্রথমে একে ভাবা হয়েছিল প্রহসন। ৬০ লাখের বেশি ভোট এবং ৩০৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট নিয়ে জো বাইডেন জয়ী হলেও সে ফলাফল মানার বদলে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়া তাকে ভোট চুরি আখ্যা দিলেন। শুধু তা–ই নয়, প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল ভোট না পেলেও তিনি নিজেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করলেন। অধিকাংশ মানুষ সেই ঘোষণাকে প্রহসন ভেবে অগ্রাহ্য করেছিলেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ঘটনা ততই ট্র্যাজেডিতে পরিণত হচ্ছে।

ভোটে না জিতেও ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে ট্রাম্পের সর্বশেষ উদ্যোগ, মিশিগান আইন পরিষদের রিপাবলিকান নেতৃত্বের ওপর চাপ প্রয়োগ। উদ্দেশ্য, ভোটের ফলাফল অগ্রাহ্য করে এদের মাধ্যমে এমন ইলেকটর বাছাই, যারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে সমর্থন করবে। এটি একটি অবাস্তব প্রস্তাব, কোনো আইনেই তা টিকবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। শুক্রবার তিনি হোয়াইট হাউসে মিশিগান আইন পরিষদের রিপাবলিকান সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এর আগে এই রাজ্যের দুজন রিপাবলিকান ভোট গণনাকারী খুচরা অনিয়মের অজুহাতে ভোটের ফলাফল সত্যায়ন করতে অস্বীকৃতি জানালে ট্রাম্প নিজে টেলিফোন করে তাঁদের সাধুবাদ জানান। অন্যান্য ভোট গণনাকারীর আপত্তির মুখে তাঁরা সিদ্ধান্ত বদলে প্রত্যয়নে সম্মত হন, কিন্তু রিপাবলিকান নেতৃত্বের চাপে পরদিন সে সত্যায়ন বাতিলের দাবি তোলেন। ভাবা হচ্ছে, এর পেছনে ট্রাম্পের চাপ কাজ করেছে। মিশিগান ছাড়াও পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে ট্রাম্প শিবির এই রণকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই তিন রাজ্যের আইন পরিষদই রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে।

মিশিগান রাজ্যের গভর্নর ও ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব নির্বাচনী ফলাফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই নগ্ন হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছেন। জো বাইডেন বলেছেন, ‘এটি আমাদের দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আমি ভেবে পাই না, এই লোকটা কী ভাবছে।’ তিনি অবশ্য আস্থা ব্যক্ত করেন ২০ জানুয়ারি তিনি ঠিকই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন।

অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বাইডেনের এই আশাবাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। ভোটারদের মতামত অগ্রাহ্য করে রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ তাদের ইচ্ছেমতো ইলেকটর বাছাই করলে আইনের চোখে ও জনমতে তা টিকবে না। তা ছাড়া রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত আইন পরিষদ যদি সে চেষ্টা করে, তাহলে এই তিন রাজ্যের ডেমোক্র্যাট গভর্নর ভিন্ন ইলেকটরের তালিকা কংগ্রেসের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। কংগ্রেসের জন্য সেটি ভিন্ন জটিলতার জন্ম দেবে।

ভোটের হিসাবে ট্রাম্পের জয়ী হওয়া সম্ভব নয়, সেকথার আরেক প্রমাণ এসেছে জর্জিয়ার ভোট পুনর্গণনা থেকে। এখানে প্রথম গণনা শেষে বাইডেন এগিয়ে ছিলেন প্রায় ১৪ হাজার ভোটে। পুনর্গণনার পর এই ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ১২ হাজারের মতো। অর্থাৎ হাজার দুয়েক ভোট হাতবদল হয়ে ট্রাম্পের বাক্সে এসেছে। এই রাজ্যের রিপাবলিকান সেক্রেটারি অব স্টেট, যাঁর তত্ত্বাবধানে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, তিনি জানিয়েছেন, পুরো ৫০ লাখ ভোট হাতে গোনা হয়েছে। ভোটের হিসাবে যে নামমাত্র গরমিল, তা কারচুপির জন্য নয়, হিসাব রাখার ত্রুটিজনিত। তাঁর কথায়, এর ফলে আবারও প্রমাণিত হলো, এই রাজ্যের ভোটে কোনো কারচুপি হয়নি।

তাতে অবশ্য ট্রাম্প শিবির থেকে কারচুপির দাবি তোলা বন্ধ হয়নি। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি দাবি করেন, ট্রাম্প শুধু জিতেছেন, তা–ই নয়, তিনি বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, জো বাইডেনের ব্যক্তিগত নির্দেশনায় ডেমোক্র্যাটরা এই নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প শিবির দুই নতুন ‘অপরাধী’র খোঁজ দিয়েছে। এঁদের একজন ভেনেজুয়েলার সাবেক একনায়ক হুগো শাভেজ, যিনি সাত বছর আগে মারা যান। অন্যজন উদারনৈতিক ইহুদি ব্যবসায়ী জর্জ সরোস। যে ভোট গণনা মেশিন কোনো কোনো রাজ্যে আংশিক ব্যবহৃত হয়, সেটির প্রস্তুতকারক ভেনেজুয়েলার এক কোম্পানি, অতএব সাত বছর আগে মৃত শাভেজ তার জন্য দায়ী। তবে সরোস কেন দায়ী, সেটি অবশ্য খোলাসা হয়নি। জুলিয়ানির এক সহকর্মী দাবি করেন, ডেমোক্র্যাটদের পেছনে কমিউনিস্টরা কোটি কোটি ডলার ঢেলেছে। সে কথা হয়তো সরোসের উদ্দেশেই বলা, যদিও সরোস কখনোই কমিউনিস্ট ছিলেন না।

নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন এই দাবিকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে বাতিল করে দিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টফার ক্রেবস, চার দিন আগে যাঁকে এবারের নির্বাচন সবচেয়ে নিরাপদ বলায় ট্রাম্প চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন, তিনি জুলিয়ানির এই সংবাদ সম্মেলনকে ‘বিপজ্জনক’ অভিহিত করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস কোনো প্রমাণ ছাড়া কারচুপির দাবিকে ‘সম্পূর্ণ বানানো’ বলে বর্ণনা করেছে। সংবাদ সম্মেলনে জুলিয়ানি দাবি করেন, তাঁদের কাছে বিস্তর প্রমাণ রয়েছে, আদালতে তাঁরা অভিযোগ প্রমাণ করেই ছাড়বেন। টাইমস মন্তব্য করেছে, জুলিয়ানির জন্য সমস্যা হলো, আদালত সেই অভিযোগ বিবেচনার পর তা ইতিমধ্যেই ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দিয়েছেন।

বিস্ময়কর হলো, কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতে বাতিল হলেও রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্ব ও তৃণমূল সমর্থকদের অধিকাংশ বিশ্বাস করেন, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের জেতা নির্বাচন ছিনিয়ে নিতে চান। মনমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনমত জরিপ অনুসারে, ৭৭ শতাংশ রিপাবলিকান ভোটার মনে করেন, ভোটে কারচুপি হয়েছে। ‘পলিটিকো’র হিসাব অনুসারে, মার্কিন সিনেটে প্রতি দশজনের সাতজন সিনেটর একই কথা বিশ্বাস করেন।

একথার অর্থ, পুরো মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, এখানে ভোট চুরির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়া যায়, ট্রাম্পের সাত কোটি ভোটারের দুই-তৃতীয়াংশ এ কথায় বিশ্বাস করেন। ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন যদি নিরাপদে দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণে সমর্থ হন, তাহলেও এই সাত কোটি সমর্থকের একটি বড় অংশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর বৈধতা অস্বীকার করে যাবেন। অনেকেই মনে করেন, তাঁর এই বিশাল সমর্থক বাহিনীকে ধরে রাখার জন্যই ট্রাম্প নির্বাচনে জালিয়াতির এই গল্প জিইয়ে রাখতে চান। অন্য কারণ, তাঁদের হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নামে যখন-তখন চাঁদা সংগ্রহেও এঁরা ভূমিকা পালনে সক্ষম।

ভোট কারচুপির কল্পকাহিনি প্রচার করে ট্রাম্প ও তাঁর পরিবার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হলেও মার্কিন গণতন্ত্র বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। ভোট কারচুপির গল্প ফেঁদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচন নামক সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সাবেক সহকর্মী পেগি নুনান ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় এক নিবন্ধে বলেছেন, এর জন্য একা ট্রাম্প নন, পুরো রিপাবলিকান নেতৃত্ব দায়ী। তিনি লিখেছেন, ভোট নিয়ে যা হচ্ছে, তা একটি ফালতু বিতর্ক, অথচ তার ফলেই আমাদের গণতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এখন থেকে দুই মাস পরে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন, কিন্তু তত দিনে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়।

If you like the post, share it and give others a chance to read it.

মাহমুদুল হাসান ইজাজ

This author may not interested to share anything with others on this site.