বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী নামকরা অনন্য এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ।১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ই নভেম্বর উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেব যাত্রা শুরু করে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং প্রকৃতপক্ষেই তারা এ অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয়। ইংরেজরা এসময় নিজেদের শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এ মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকেরা তাদের রাজত্বের অধিবাসীদের জন্য কোনো শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করেনি। এ দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিলো। অবশেষে ১৮৩০-এর দশকে নেয়া সরকারের শিক্ষানীতি অনুযায়ী ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) এর শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনের সাপেক্ষে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিলো ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।
পরবর্তীতে গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) কতগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করার প্রেক্ষিতে অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়, যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলের নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার চিত্র, ঢাকা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয় কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত ব্যবস্থাপনার ভিত্তি।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। তবে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা আবার হোচট খায়, কেননা ঢাকা কলেজের ইউরোপীয় শিক্ষকরাও ঐ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে পরবর্তীতে এ ক্ষতি পুষিয়ে বরাবরের মতো জাগ্রত হয় প্রতিষ্ঠানটি,পূর্ববঙ্গের স্কুল-কলেজ পরিদর্শক তার ১৮৫৯-৬০ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, ঢাকা কলেজে যে কোর্স পড়ানো হয়, তা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষার কোর্সের সমতুল্য। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটা ছিলো পূর্ববাংলার ছাত্রদের জন্য একটি বৈপ্লবিক ইতিহাস। পরবর্তীতে নানা ঘাতপ্রতিঘাত থাকলেও, ঢাকা কলেজ শিক্ষাক্ষেত্রে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলো, যার সোনালী ফসল ছিলো ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য এক নিদর্শন কার্জন হল, তবে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এই কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের জন্য। লাল রঙের দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপত্য নিদর্শন যে কারও নজর কেড়ে নেয়। ভিক্টোরীয় স্থাপত্যরীতি ও মোগল স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনটি ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি ভাইসরয় লর্ড কার্জন ন্যাথনিয়েল কার্জন ঢাকায় এসে উদ্বোধন করেন। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে,১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এটি ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, কার্জন হল মূলত ঢাকা কলেজের নতুন ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাবির বিজ্ঞান বিভাগের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ভবনটি, এখনো সেভাবেই চলছে।
উপমহাদেশের নানাবিধ আন্দোলন সংগ্রামে, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা কলেজের ছাত্র শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের রয়েছে অসামান্য অবদান। শিক্ষাবিস্তারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃষ্টান্ত রেখে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।দেশ বরেণ্য অজস্র কবি,সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ,সাংবাদিক তৈরিতে অবদান রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি বর্তমানে ১৯ টি বিভাগ নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া নানাবিধ সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে এবং অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের। ছাত্রদের থাকার জন্য এ কলেজে বর্তমানে রয়েছে ৮টি ছাত্রাবাস। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের ন্যায় ভবিষ্যতেও ঐতিহ্য ও গৌরব ধরে রাখবে বলে আশাবাদী।
লেখকঃ মাহমুদুল হাসান ইজাজ,
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ