চার ম্যাচে ৬৯ গোল খাওয়ার লজ্জাজনক ইতিহাস ব্রাজিলের ক্লাবের

পরিসংখ্যান-পোকারা টেনে আনতে পারেন ১৮ বছর আগের সেই ম্যাচ। মাদাগাস্কারে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ প্লে অফে লা’এমেরেনকে ১৪৯-০ ব্যবধানে হারিয়েছিল আদেমা। পাতানো ম্যাচের অভিযোগ থাকলেও পেশাদার ফুটবলে এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যবধানে হারের রেকর্ড। এর ১১৭ বছর আগে স্কটিশ কাপে বোন অ্যাকর্ডকে ৩৬-০ গোলে হারিয়েছিল আরব্রোয়াথ। শিরোনামের সঙ্গে এসব ম্যাচের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে এত বড় ব্যবধানে হারের পর দলগুলো নিশ্চয়ই পরের ম্যাচগুলোয় সেই ধারা অব্যাহত রাখেনি। অন্তত হয়তো হারলেও ব্যবধান নিশ্চয়ই মনে রাখার মতো হয়নি।

তখন বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল তাবোয়াও। দলটির সমর্থকেরা হয়তো স্রেফ একটা বাজে দিন ভেবে কিংবা দুর্ঘটনা মনে করে সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিলেন। ওদিকে বিধিলিপি নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছে। পরের তিন ম্যাচে তাবোয়াওয়ের হারের ব্যবধান দেখুন, ১৪-০, ১০-০ ও ১৬-০! টানা কয়েক ম্যাচে এত বড় বড় ব্যবধানে হারের এমন রেকর্ড আর আছে কি না, তা সত্যিই গবেষণার বিষয়। চার ম্যাচে ৬৯ গোল খেয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেছে দলটি।

ব্রাজিলে মেয়েদের ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেমন, তা আন্দাজ করতে গবেষণা নয় এসব স্কোরলাইন দেখেই টের পাওয়া যায়। সাও পাওলো আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়েছে তাবোয়াও। এদিকে ফুটবল-পণ্ডিতরা প্রশ্ন তুলছেন, ব্রাজিলিয়ান নারী ফুটবলে খেলার মান নিয়ে। আর মাঠে লিঙ্গবৈষম্যমূলক কটূক্তি শোনা তো আছেই, যার সঙ্গে ব্রাজিলের নারী ফুটবলারদের পরিচিতিও বেশ আগে থেকে।

তাবোয়াওয়ের অধিনায়ক লোয়ানে ফেরেইরা জানালেন সে কথা, ‘আমরা হারের পর “সবাই বলেছে, গোটা দলকে দেখে মনে হয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত” কিংবা খেলছ কেন—এমন সব কথা শুনতে হয়েছে। এমনভাবে বলেছে যেন ফুটবল শুধু পুরুষের খেলা, নারীদের বাসায় থেকে বাসন-কোসন পরিষ্কার করা উচিত, যেন পুরুষের ক্রীতদাস। বেশির ভাগ (মেয়ে) ফুটবলার এমন সব কথা শুনে থাকে।’ফেরেইরার এই মন্তব্য ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে মেয়েদের অবস্থান বুঝিয়ে দিতে যথেষ্ট। অথচ এই ব্রাজিল অনেকের কাছেই ফুটবলের আধ্যাত্মিক ঘর, পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রাজিল নারী ফুটবল দলও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এ দেশ থেকেই উঠে এসেছেন মেয়েদের মধ্যে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ছয়বারের বর্ষসেরা মার্তা—‘স্কার্ট পরা পেলে’। তবে মার্তার সঙ্গে ব্রাজিলের বেশির ভাগ নারী ফুটবলারের পার্থক্যটা মোটাদাগে। মার্তাকে পুরো বিশ্ব চেনে–জানে, ব্রাজিলের বাইরে তাঁর জীবনটা বিলাসব্যসনে ভরপুর। কিন্তু ব্রাজিলে খেলা বেশির ভাগ নারী ফুটবলারের ভাগ্য হেঁটে থাকে ঠিক উল্টো পথে।শুধু তাবোয়াওয়ের মতো ছোট দলগুলোই নয়, মেয়েদের বড় দলগুলো নিয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে।

অনুশীলনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, খেলার জন্য ভালো সরঞ্জামেরও অভাব, আর ছেলেদের ফুটবলের সমান পারিশ্রমিক দেওয়ার বিষয়টি তো দূর অস্ত।ম্যাচের এক মুহূর্তের স্কোরলাইন। পরে সেখানে আরও তিন গোন যোগ হয়েছে। এ বছর লিগ শুরুর তিন দিন আগে অনুশীলনের মাঠ পেয়েছে তাবোয়াও। আর অনুশীলনের সরঞ্জাম, পোশাক ও অন্য জিনিসপত্রসহ প্রস্তুতি নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে দলটির ফুটবলারদের।

‘আমরা কোনো সাহায্য পাইনি, এমনকি বুটও না। টাকা খরচ করে নিজেদের সরঞ্জাম কিনতে হয়েছে খেলোয়াড়দের। অনুশীলনে আসতেও খরচ হয়েছে। যাতায়াতে প্রতিদিন সবার খরচ হয়েছে ২০ থেকে ৩০ রিয়াল (৩১৫ থেকে ৪৭০ টাকার মতো)। কারও কারও বাসায় যেতে দু-তিন ঘণ্টা লাগে, কেউ আবার কাজ থেকে সরাসরি চলে আসে অনুশীলনে’—সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন তাবোয়াও মিডফিল্ডার আলিয়েনি বাচেইগা রসচেল।আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ছিটকে পড়ায় তাবোয়াওয়ের সামনে আপাতত কোনো ম্যাচ নেই। অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছর পর্যন্ত। সাও পাওলো আঞ্চলিক পেশাদার ফুটবলে চতুর্থ স্তরের এই ক্লাবের নারী দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও তাই প্রশ্ন উঠেছে।

ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে আর দশটি দলের মতোই ক্লাবটি ভুগছে টাকা-পয়সার সংকটে। এই করোনাকালে বিষয়টি আরও বেশি করে ভোগাচ্ছে। ক্লাব-কর্মকর্তারা ছেলেদের ফুটবল নিয়েই ভাবছেন বেশি।বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে থাকে ছেলেদের দলের জন্য। এভাবে হাসিঠাট্টার ভাগীদার না হয়ে আগামী বছর শুধু ছেলেদের ফুটবলেই বিনিয়োগ করা যায় কি না, সেটাও ভাবছে ক্লাব।এদিকে মেয়েরাও হাল ছাড়ছেন না। অনুশীলনের জন্য তাঁরা একটি মাঠ ধার করে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা হয়তো কবির সুমনের সেই গানটি শুনেছে—‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে/ দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে।’

ফেরেইরার কণ্ঠেও শোনা গেল তেমন প্রতিধ্বনি। ব্রাজিল নারী জাতীয় দলের ফুটবলারদের বিপক্ষে খেলার (ঘরোয়া) সুযোগটা তাঁর কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা, ‘সব বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে এটি আমার কাছে জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা। ছেলেপুলে ও নাতি-নাতনিদের বলতে পারব, ওদের বিপক্ষে খেলেছি।’

If you like the post, share it and give others a chance to read it.

মাহমুদুল হাসান ইজাজ

This author may not interested to share anything with others on this site.